মেয়েটি আমার পরিচিত | লেখা- আলেমা মাজিদা রিপা



মেয়েটি আমার পরিচিত। এত ভালো সে; তার স্বভাব আমাকে ঈর্ষান্বিত করে। জয়েন্ট ফ্যামিলির বউ সে। পুরুষরা নিজেদের মতো থাকে। ঘরের মহিলাদের কাজ করতে হয়। কাজের ফাঁকে বউটি খুব কমই কুরআন নিয়ে বসতে পারে। যে সময়টা বের হয় ওই সময়টা নিজের ছোট বাচ্চাদের কাজগুলো সেরে রাখতে হয়। এত কাজের কারণে ঘুমও ওভাবে বাদ দেয়া যায় না, ইফতার সেহরি সবকিছুর পর ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে আসে। এই মেয়েটাকে যদি আমদের কেউ দশদিনে পাঁচটা খতম দিয়ে জিজ্ঞেস করি 'কত খতম দিয়েছো, কত আমল করেছো,' তার কেমন লাগে?
আমরা মানুষকে জাজ করি খুব সহজে। তাদের উপদেশ দেই কাজ কমাও, খাবার কমাও, এই সেই, অথচ তার অবস্থায় আমি নেই। আমার ফ্যামিলির অবস্থা আর তার ফ্যামিলির অবস্থা এক নয়। আমার হয়তো ছোট পরিবার, অথবা বড় পরিবার হলেও নিজের ইচ্ছায় চলতে পারি, কিন্তু সে যে খাবার কমাবে, রান্না কমাবে, দেখা যাবে ওই ক্ষমতাই তার নেই। শ্বাশুড়ির মুখ কালো, শ্বশুর বাসি খাবার খান না, স্বামী জালিম হলে তারও কত এক্সেপটেশন। এইসব ঝামেলা থেকে বাঁচতেই মেয়েটি হয়তো আমার চেয়ে নফল ইবাদত কম করলো। ধরুন, করলোই না। তার মানে সে কি কম সওয়াবের অধিকারী হয়ে গেল? মনে রাখবেন কেয়ামতের দিন ইবাদত গণনা করা হবে না, ইবাদত ওজন করা হবে। কারো সময় থাকলে যতবেশি সম্ভব পড়ুন নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতিদান দিবেন, কিন্তু যারা পরিবারে ব্যস্ত থাকে তাদের কয় খতম দিয়েছেন, কী কী আমল করেছেন এই প্রশ্ন করা বন্ধ করুন।
ওই যে অতৃপ্তি, তিলাওয়াত করতে না পারার হাহাকার, ওটা কি তার ইবাদত নয়?
বাচ্চা দেখাশোনা কি ইবাদত নয়?
রান্নাবান্না কি ইবাদত নয়?
স্বামীর সন্তুষ্টি কি ইবাদত নয়?
ওয়াল্লাহি, তার প্রত্যেকটা কাজ ইবাদত যদি সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়। সে যদি শুধু বিসমিল্লাহ পড়ে ঘুমায় যেন সুস্থ থাকে, যেন শিশুর মুখে সকালে হাসিমুখে লোকমা তুলে দিতে পারে, তবে তার ঘুমটুকুও ইবাদত।
ওয়াল্লাহি, ভালোবেসে সন্তানকে চুমু খেলেও সে একটি সুন্নাত আদায় করার সওয়াব পেল।
ঝগড়া বিবাদ এড়ানোর জন্য সারাদিন কাজ করলো, তার সারাদিনের কাজ ইবাদত। আর সাথে সাথে তিলাওয়াতের রেকর্ড শুনলে, ইস্তেগফার দুরুদ অন্তরে মুখে সে জারি রাখলে তো সোনায় সোহাগা।
এবার কিছু টিপস :
১. আপনি কারো কন্যা হলে নিজের পরিবারে নিজের বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলুন রমজানে রান্না কমাতে। বাবাকে বলুন, রমজানে আইন করে দিতে সেহরিতে ইফতারে একটাই আইটেম রাখতে। আর পুরো পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে প্রতিদিনের কাজ ভাগ করে দিতে।
২.আপনি স্ত্রী হলে স্বামীর সামনে কয়েকটি কাজ তুলে ধরে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন, আপনার প্রতি ইহসান করতে। যে কোনো একটি দুটি কাজ প্রতিদিনের বেছে নিতে যাতে আপনার একটু হলেও নিস্তার মিলবে। যেমন, বাচ্চাকে সকালে অথবা বিকালে খাওয়ানোর দায়িত্ব। অথবা গোসলের দায়িত্ব। অথবা একদিন বাচ্চার দায়িত্ব আপনার, একদিন তার, ওরকম। যেদিন বাচ্চার দায়িত্ব তার নয়, ওইদিন আপনাদের কাপড় বিছানা, ঘর তিনি গোছাবেন।
৩.আপনি পুরুষ হলে আপনি তাই করবেন যা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন। মদিনা রাষ্ট্র, নবুওয়াতের দায়িত্ব, শিক্ষকের দায়িত্বসহ হাজারটা দায়িত্ব পালনের পরও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করতেন? নিজের সব কাজ নিজে করতেন। ঘরের কাজেও সাহায্য করতেন। আর আপনি যদি পরিবার সমাজকে ভয় পান যে, ঘরের কাজ করলে লোকে স্ত্রৈণ বলবে, তবে জেনে নিন আপনি আল্লাহর দাস আর নবীজির অনুসারী নয়, আপনি পরিবার প্রথা ও সমাজের দাস। আপনাকে আর যাই হোক, পুরুষ বলা যায় না, বড়জোর সমাজের ভয়ে ভীত কাপুরুষ বলা যায়। প্লিজ বি এ ম্যান, নট এ কাওয়ার্ড।
৪.আপনি একজন পুত্র, স্বামী, ভাই হলে অন্তত এইটুকু করতে পারেন যে, আপনার খাওয়ার অভ্যাসটা রমজানে কমাতে পারেন। এটা ওটা পছন্দ বাদ দিয়ে স্ত্রীকে, মাকে কঠোরভাবে নিষেধ করতে পারেন আপনার জন্য যেন আলাদা কোনো খাবার তৈরি না করেন। মনে রাখবেন, আপনি বড়জোর আপনার ঘরের প্রধান অথবা উপপ্রধান হতে পারেন, কিন্তু যিনি সমস্ত মানবজাতির প্রধান তাঁর সেহরি ও ইফতার ছিল একদমই সাধারণ খাবার। তবে আপনি কেন পারেন না, সংযমের মাসে একটু সংযম দেখাতে, আপনার মা বোন স্ত্রীকে একটু মুক্তি দিতে?
৫. তবু যদি কোনো বোনের সমস্যা হয়, আপনি ঘরের এমন বউ অথবা এমন মা যে, সারাদিন কাজ করে খুব বেশি নফল ইবাদতের সময় পান না। তাহলে মন খারাপের কিছু নেই। রান্না করতে করতে তাফসীর তিলাওয়াত শুনুন। বাচ্চাদের খাওয়াতে খাওয়াতে ছোট ছোট সূরা পড়ুন, ওরাও শিখবে, আপনারও পড়া হবে। যখন মনে পড়ে দুরুদ ইস্তেগফার পড়ুন। স্বামী ও পরিজনের সাথে হাসিমুখে কথা বলুন, বাচ্চাদের আদর করুন। মূলকথা নিয়ত সহিহ রাখুন। ব্যস, আপনার ইবাদত কারো চেয়ে কম হবে না ইনশাআল্লাহ।
সংসারের ব্যস্ততায় মনমতো আমল করতে পারছেন না বলে রাগ বিদ্ধেষ, সন্তানের গায়ে হাত তোলা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন। নিশ্চয়ই জানবেন, সারাক্ষণ গর্দান ঝুকিয়ে রাখার নাম ইবাদত হলে, সারাদিন কুরআন পড়া ইবাদত হলে রব আমাদের ক্ষিধে নামক নিয়ামত দিতেন না, সন্তান নামক উপহার দিতেন না, সংসার নামক সুখ দিতেন না। ইবাদত তাই যা শুধু এবং শুধু আপনার রবকে সন্তুষ্ট করে। চাই তা একটা পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানো হোক না কেন!
লিখেছেন - শ্রদ্ধেয়া আলেমা আপা
Majida Rifa

Post a Comment

Previous Post Next Post

Nepali Graphics - Learn design, Animation, and Progrmming