সফলতার চার সূত্র | লিখেছেন- আরিফ আজাদ | সূরা আসরের আলোকে | বেলা ফুরাবার আগে


সূরা আল আসর। কুরআনের সবচেয়ে ছোট সূরাগুলোর মধ্যে একটি। কলেবরে ছোট, কিন্তু যে বার্তা এই সূরা ধারণ করে তা মোটেও ক্ষুদ্র নয়। বলা চলে পুরো কুরআনের সারমর্মই আমাদের সামনে তুলে ধরে এই সূরাটি। এজন্যেই ইমাম শাফিয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ যদি কেবল সূরা আল-আসরের মর্মার্থ বুঝতে পারতো, তাহলে বাকি কুরআন তাদের জন্য দরকার হতোনা’। সূরা আল-আসরের গুরুত্ব সাহাবিদের কাছে এতোই বেশি ছিলো যে, তারা যখন একজন-অন্যজনের সাথে সাক্ষাত করতেন, সাক্ষাত শেষ করার পূর্বে তারা সূরা আল-আসর তিলাওয়াত করতেন।
সূরা আল-আসর শুরু হয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার একটি শপথ দিয়ে। তিনি সময়ের শপথ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা যখন কোন বস্তু নিয়ে শপথ করেন, তখন বুঝতে হবে বস্তুটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময় যে আমাদের জীবনে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সেটা যারা সময়ের কাজ সময়ে না করে ভুক্তভোগি হয়েছে, কেবল তারাই বুঝতে পারে। এই সূরায় আল্লাহ সময়কে উল্লেখ করেছেন ‘আসর’ শব্দ দিয়ে। আরবিতে ‘আসর’ বলতে এমন এক সময়কে বুঝায় যা ক্রমাগত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটাকে আমরা আরো সহজে বুঝতে পারি আসর সালাতের ওয়াক্তের দিকে তাকালেই। আসরের সালাত আমরা কখন পড়ি? দিনের একেবারে শেষ লগ্নে। আসরের পরের ওয়াক্তই হচ্ছে মাগরিব। অর্থাৎ, আসর হচ্ছে দিনের সর্বশেষ অংশ। এরপরেই সূর্যাস্ত। মানে, মাগরিব। আমাদের জীবনটাকে যদি একটা পূর্ণাঙ্গ ‘দিন’ হিশেবে ধরি, তাহলে ‘আসর’ হচ্ছে আমাদের জীবনের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের মতোন। এমন মুহূর্ত যার ঠিক একটু পরেই আমাদের মৃত্যু হবে।
কেউ কেউ আবার ‘আসর’ শব্দটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘আসর’ বলতে এমন এক অবস্থার কথা তারা বুঝিয়েছেন যা ক্রমশঃ গলে যাচ্ছে। যেমন- একখন্ড বরফ টুকরো। বরফের টুকরোটা সময়ের ব্যবধানে কেবল গলতেই থাকবে। একটা পর্যায়ে গিয়ে সম্পূর্ণটা গলে নিঃশেষ হয়ে যাবে। ‘আসর’ হচ্ছে সেরকম সময় যা ক্রমশই গলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই অর্থ ধরে যদি আমরা সূরা আল-আসরের প্রথম দুই আয়াতকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে খুব চমৎকার একটা ব্যাপার আমরা উপলব্ধি করতে পারবো। আল্লাহ বলছেন, ‘শপথ এমন সময়ের যা ক্রমাগত ফুরিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত’।
সময়ের সাথে মানুষের ক্ষতির কি সম্পর্ক? আদতে, আমরা হলাম সময়েরই সমষ্টি। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার অর্থই হলো ক্রমাগত আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া। সময় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা আখিরাতের ব্যাপারে চরম উদাসীন। আমরা যদি নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো অধিকাংশ লোকই আখিরাত বিমুখ। তারা এমনভাবে জীবনযাপন করছে যেন মৃত্যু কখনোই তাদের গ্রাস করবেনা। এই যে সময়ের সাথে আমাদের বিচ্ছিন্নতা, সময়ের ব্যাপারে উদাসীনতা- এই উদাসীনতার মাঝেই আমাদের অধিকাংশের মৃত্যু হয়। আমরা না দুনিয়া অর্জন করতে পারি, না আখিরাত। ফলে, এ-কূল ও-কূল, কোন কূলই আমাদের আর পাওয়া হয়না। এরচেয়ে বড় ক্ষতি আমাদের জন্য আর কি হতে পারে?
সূরাটির প্রথম দুই আয়াতে আল্লাহর শপথ এবং সতর্কবাণীর পর, পরের আয়াতে আল্লাহ এমন কিছু বৈশিষ্ট্য তথা গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন যা কারো মাঝে থাকলে সে কখনোই অসফল হবেনা। অর্থাৎ, সময়ের অপব্যবহার, অপব্যয় এবং সময়ের ব্যাপারে চরম উদাসীন হয়ে অসফল ব্যক্তি-বর্গের বাইরে এমনকিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা ধারণ করতে পারলে মানুষ সফল হতে পারবে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলো কি তাহলে? আল্লাহ বলছেন:
‘যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, সত্যের দাওয়াত দেয় এবং ধৈর্যের দাওয়াত দেয়’।
একটি ভয়ঙ্কর শপথ বাক্যের পরে, অধিকাংশ মানুষের ক্ষতির ইশতেহার ঘোষণার পরে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা সফলতার চারটি সূত্র এখানে বলে দিয়েছেন। সেই চারটি সূত্র হলো:
১. যারা ঈমান আনবে।
২. এরপর যারা আমলে সালিহ তথা নেক আমল করবে।
৩. যারা সত্যের দাওয়াত দিবে, এবং
৪. যারা ধৈর্যের উপদেশ দিবে।
এই হলো আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত সফল হওয়ার চারটে সূত্র। আবারও বলি, এই সূত্র প্রণেতা কিন্তু দুনিয়ার কোন মোটিভেশনাল স্পিকার নয়, নয় কোন বিশাল মাপের সেলেব্রেটি। সমস্ত সৃষ্টিজগতের যিনি মালিক, তিনিই এই সূত্রের প্রণেতা। সুতরাং, এই সূত্রের কার্যকারীতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
সফল হতে হলে আমাকে-আপনাকে সর্বপ্রথম ঈমান আনতে হবে। এটা একেবারে বুনিয়াদি, মৌলিক দাবি। ঈমান ব্যতীত কোন অবস্থাতেই আমরা সফল হবার আশা করতে পারিনা। ঈমান হলো- আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, নবি-রাসূল, আখিরাত, ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, পুনরুত্থান ইত্যাদি ব্যাপারে অন্তরের গভীর থেকে বিশ্বাস করা। এসব ব্যাপারে মনে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস, সন্দেহ না রাখা। যখনই আমরা প্রথম শর্তকে মন থেকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলবো, তখনই আমাদের দ্বিতীয় কাজ হলো নেক আমল করা। নেক আমলের মধ্যে আমাদের দাঁড়ি রাখা থেকে শুরু করে একেবারে অন্ধকার গভীর রাতের তাহাজ্জুদ- সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। ঈমান এবং আমলের দুটো শর্ত পূরণ করার পর আমাদের সামনে বাকি থাকে আর দুটো শর্ত। সেই শর্ত দুটো হলো- সত্যের দাওয়াত দেওয়া এবং ধৈর্যের দাওয়াত দেওয়া। যখন আমরা সত্যের ওপর ঈমান এনে, আমল করা শুরু করবো, তখনই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। সত্যের সেই দাওয়াত চতুর্মুখে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রচার করো যদি একটি আয়াতও হয়’। নিজেদের জীবনে আকড়ে ধরা সত্যকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াটাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা শর্ত হিশেবে উল্লেখ করেছেন। এই শর্ত পূরণের জন্য আপনাকে-আমাকে অবশ্যই অনেক বড় স্কলার, অনেক বড় মাপের আলেম হতে হবেনা। আমাদের সুন্দর ব্যবহার হতে পারে কিছু মানুষের জন্য দাওয়াহ। হতে পারে তাদের পরিবর্তনের পেছনের নিয়ামক। আমাদের মার্জিত, বিনম্র আচরণ, আমাদের তাকওয়া, আমাদের ইখলাস, আমাদের ন্যায়নিষ্ঠতা হতে পারে দাওয়াহর মাধ্যম। এগুলো দেখেও মানুষ দ্বীনের দিকে ঝুঁকতে পারে। আমরা যখন বাবা-মা’র সাথে ভালো আচরণ করবো, তাদের হকগুলো আদায় করবো, প্রতিবেশিদের সাথে মিলেমিশে থাকবো, তাদের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসবো, আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ-খবর রাখবো- তখন আমাদের এই ভালো কাজগুলো দেখে আমাদের অধীনস্ত অনেকে পরিবর্তন হবে, ইন শা আল্লাহ। এভাবেও নীরবে দাওয়াহ হতে পারে। এবং, প্র্যাকটিক্যালি যে দাওয়াহ হয়, সেটা হয় সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসু।
সত্যের দাওয়াত দেওয়ার পরে আসে ধৈর্যের দাওয়াত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার বাতলে দেওয়া সফলতার সর্বশেষ ফর্মুলা। আপনি যখন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সত্যের দাওয়াত নিয়ে হাজির হবেন, তখন আপনার ওপর নেমে আসবে নানান পরীক্ষা। আপনার প্রিয়মুখ, প্রিয়জন আপনার শত্রুতে পরিণত হবে। আপনার চিরচেনা পরিবেশ আপনার কাছে অচেনা লাগবে। জগতের নিয়ম আপনার জন্যে তখন পাল্টে যাবে। আপনি তখন একা হয়ে পড়বেন। মনে হবে বিশাল বিরান এক মুরুভূমিতে আপনি খুব খুব একা। এমন অবস্থায় আপনার জন্য যা দরকার তা হলো- ধৈর্য ধারণ। এজন্যেই এটাকে সফলতার সর্বশেষ ধাপে রাখা হয়েছে।
সূরা আল-আসরকে একনজরে বুঝতে নবি-রাসূলদের জীবনীর চেয়ে উত্তম আর কিছুই হতে পারেনা। নিঃসন্দেহে তারা সকলে ছিলেন সফল মানব। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা সূরা আল-আসরে ‘সফল’ হবার জন্যে আমাদের যে চারটা মূলনীতির কথা শুনাচ্ছেন, সেই চারটার সবকয়টি তাদের জীবনে পরীক্ষিত। তারা দুনিয়ার সমস্ত উপাস্যকে অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছেন। ঈমান আনার পরে তারা আমল করেছেন। তাদের মতো আমল দুনিয়ায় আর কোন বান্দাই করতে পারবেনা। আমল করার সাথে সাথে তারা সত্যের দাওয়াত পৌঁছানোর কাজে লেগে যান। এবং, এই কাজ করতে গিয়েই তারা জীবনের পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হোন। তখন তাদের দরকার পড়ে ধৈর্যের। তারা ধৈর্য ধরেছেন এবং ধৈর্য ধারণের দাওয়াতও দিয়েছেন। এই তো সূরা আল-আসরের নির্যাস। শিক্ষা। নবি-রাসূলদের পুরো জীবনটাই একটুকরো সূরা আল-আসর।

#Islamic 

Post a Comment

Previous Post Next Post

Nepali Graphics - Learn design, Animation, and Progrmming